অধিনায়ক
তিনি, নায়কও। কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না এই
ক্রিকেট-তারকার খেলোয়াড়ি-জীবন। বাধা এসেছে বারবার।
তবে অদম্য মনোবলে জয়ও করেছেন সব
বাধা। মাশরাফি বিন মুর্তজা তাঁর
বর্ণিল জীবনের নানা চমকপ্রদ অজানা
অধ্যায় উন্মোচন করেছেন উৎপল শুভ্রর কাছে
ভিন্ন
অনুভবে
উৎপল
শুভ্র: আপনার প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ এর আগেও দেখেছি।
একটু আগে আবার দেখলাম।
আপনাকে নিয়ে গান লিখে,
সুর করে আপনাকে তা
শুনিয়ে গেলেন পরপর দুজন। এটা
তো অভাবিত একটা ব্যাপার। আমার
মনে হয়, খেলার সীমানা
ছাড়িয়ে সব ক্ষেত্র মিলিয়েই
বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা আপনাকে
ঘিরে। একে আপনি কীভাবে
দেখেন?
মা হামিদা মুর্তজা ও বাবা গোলাম
মুর্তজা
মাশরাফি
বিন মুর্তজা: অবশ্যই পজিটিভলি দেখি। তবে আমার মনে
হয়, এটা পাওয়ার চেয়ে
রক্ষা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ অনেক, অনেক অনেক কষ্ট
করে অনেক কিছু পায়।
আবার দেখা গেল, অনেক
দিন ধরে আমার চেয়ে
বেশি কষ্ট করেও অনেকে
অনেক কিছু পায়নি। এ
রকম মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আমার
চোখের সামনেই আছে। তারাও কিন্তু
অনেক ভালো কাজ করছে। তারা
যা পায়নি, আমরা শুধু ক্রিকেট
খেলেই তা পেয়ে গেছি
(হাসি)। আমাদেরটা দৃশ্যমান,
ওদেরটা দৃশ্যমান না। তবে যেটা
বললাম, গুরুত্বপূর্ণ হলো এটা ধরে
রাখা। মানুষের একটা কিছু অর্জন
করতে অনেক দিন লাগে।
যেতে বেশি সময় লাগে
না। ওভাবেই চিন্তা করি আর কী!
মানুষ ভালোবাসে, কারণ অনেকে হয়তো
চিন্তা করে, আমি ভালো
কাজ করছি। আমিও চেষ্টা করি
ভালো কিছু করার। আর
খেলাটা তো পেশা। সঙ্গে
দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা, এটা ভিন্ন
একটা ব্যাপার।
শুভ্র:
কিন্তু আপনাকে নিয়ে মানুষের এই
তীব্র আবেগ কি কখনো
ভয় পাইয়ে দেয়? এই আবেগ
তো কখনো কখনো যুক্তি-বুদ্ধি মানে না। যার
পরিচয় আমিও পেয়েছি। আপনি
গত বছর ভারতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর অবসর নিতে
পারেন বলে একটা আভাস
দিয়েছিলেন। এ নিয়ে একটা
লেখা লিখে আমি পাঠকদের
তীব্র ক্ষোভের মধ্যে পড়েছিলাম। সবাই ধরে নিল,
আমি আপনাকে অবসর নিতে বলেছি।
অথচ ঘটনা তা ছিল
না। লেখাটা ছিল আপনার প্রতি
একধরনের নৈবেদ্য। কিন্তু পাঠকেরা সেটি বুঝলই না!
এই যে মানুষের আবেগ,
এটা তো ভয়েরও ব্যাপার,
তাই না?
মামা
নাহিদুর রহমানের পরিবারের সঙ্গে মাশরাফি
মাশরাফি:
না। দেখেন, ভয় বলে আমার
জীবনে আলহামদুলিল্লাহ কিছু নেই। যেসব
জিনিস নিয়ে ভয় পাওয়া
যৌক্তিক, তা নিয়ে হয়তো
ভয় পাই। তবে এসব
সাধারণ বিষয় নিয়ে ভয়
পাই না। আমার কাছে
এগুলো সাদামাটা বিষয়ই। জীবনের দিকে যখন তাকাই,
দেখি, এটাই আমার জীবন,
এটাই মানুষ গ্রহণ করেছে। যদি গ্রহণ না-ও করত, তাহলেও
এটাই আমার জীবন থাকত।
কারণ, একেকজন মানুষ একেক রকম থাকতে
পছন্দ করে। আমি সাদামাটাভাবে
চলতেই ভালোবাসি। এখন আমার পক্ষে
বদলানোও সম্ভব নয়। কারণ, অন্য
কিছু আমি উপভোগ করি
না। কোনো কিছু নিয়ে বেশি
ভাবিও না। ভাবা মানেই
প্রেশার। কোনো কিছু না ভাবা
মানে আপনি আপনার মতো
আছেন। আমি কি খারাপ
কাজ করি না? অবশ্যই
করি। পৃথিবীর কোনো মানুষ বলতে পারবে না
যে, আমি খারাপ কাজ
করি না বা আমার
খারাপ বলে কিছু নেই।
এমনকি যারা আমাকে পছন্দ
করে, তারাও আমার কোনো কাজ
যে অপছন্দ করে না, তা
তো নয়। সবকিছু মিলিয়েই
জীবন।
শুভ্র:
মানুষের এই ভালোবাসার কি
কোনো ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে?
একটা তো বুঝি, আপনার
কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা একটু আলাদা। আপনি
যেমন সব সময় বলেন,
ক্রিকেট খেলছেন বলে লোকে আপনাকে
মাথায় তুলে রাখছে। যেখানে
সমাজে এর চেয়ে বেশি
অবদান রেখেও অনেকে এমন ভালোবাসা বা
সম্মান পাচ্ছে না। কথাটা সত্যি,
কিন্তু তারকাখ্যাতি অনেককেই এটা ভুলিয়ে দেয়।
আপনার মধ্যে এই বোধটা কীভাবে
থাকল?
নড়াইলে
নির্মীয়মান মাশরাফির বাড়ি
মাশরাফি:
আপনি বলতে পারেন, এর
একটা কারণ ধর্মবিশ্বাস। প্রত্যেক
মানুষ তার ধর্মকে বিশ্বাস
করে। যেমন আমি প্রবলভাবে
বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে যা
কিছু হচ্ছে ওপরওয়ালার মাধ্যমেই হচ্ছে। এটা আমি সব
সময় মানি। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে দুজনকে ভয় পাই—প্রথম
আল্লাহ, দ্বিতীয় আমার মা। এই
দুটো জিনিস পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে দুর্বল
জায়গা। এর সঙ্গে আমি
ভাগ্যে প্রচণ্ড বিশ্বাসী। দেখেন, শুধু পরিশ্রম করলেই
সব পাওয়া যায় না। যদি
আমি এভাবে চিন্তা করি, একজন রিকশাওয়ালা
আমার চেয়ে বেশি খাটছে।
আপনি তাকে কীভাবে বলবেন
যে, তুমি পরিশ্রম করো,
তোমার জীবন বদলে যাবে!
২০ বছর ধরে রিকশা
চালাচ্ছে, সে আর কত
পরিশ্রম করবে? সংসারে সচ্ছলতা নেই, শান্তি নেই।
তার মানে কি সে
ঠিকমতো খাটেনি? একজন রিকশাওয়ালার দিকে
তাকিয়ে দেখেন, ভ্যানওয়ালার দিকে, একজন ড্রাইভারের দিকে...তারা কী না
করছে! তারা ছেলেমেয়েদের যেভাবেই
হোক, পড়ালেখা করাচ্ছে। আবার ওই ছেলে
বড় হওয়ার পর হয়তো তাকে
ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এর
কী ব্যাখ্যা? পরিশ্রম করলেই সাফল্য—এই কথা কি
এখানে খাটে? অনেকে শচীন টেন্ডুলকারের উদাহরণ
দেন—টেন্ডুলকার পরিশ্রম করেছে বলে এত সাফল্য
পেয়েছে। তাহলে ওই রিকশাওয়ালা কী
করছে? সে-ও তো
পরিশ্রম করছে। অনেকে বলে, আল্লাহ তোমাকে
দিয়েছে। হ্যাঁ, তোমার ‘ট্যালেন্ট’ ছিল, তুমি ভালো
করেছ। আবার আমি এটাও
বিশ্বাস করি যে, যদি
না খাটো, তাহলে তুমি কিছুই পাবে
না। শুধু ‘ট্যালেন্ট’ থাকলেই হবে না। তার
ঠিকমতো ব্যবহার করতে হবে। আবার
এটাও বিশ্বাস করি, অনেক খেলোয়াড়ই
খুব পরিশ্রম করছে, কিন্তু হচ্ছে না। তার মানে
কী, খাটলেই সবার হয় না।
তবে তখন একটা সান্ত্বনা
থাকে যে আমি আমার
সেরাটা দিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি,
তুমি যা পেয়েছ, যেখানে
আছ, পরিশ্রম না করলে ওখান
থেকে ওপরে যাওয়া সম্ভব
নয়। হয়তো নিচে যাবে, কিন্তু
ওপরে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার এটাও
বিশ্বাস করি না যে,
শচীন টেন্ডুলকার এত রান করেছেন,
এটা শুধু ওঁর যোগ্যতাতেই
করেছেন। আজকে আমি এত
ভালোবাসা মানুষের পেয়েছি বা আমার এই
যে ক্যারিয়ার, তা যেমনই হোক—আমি বিশ্বাস করি
না যে, এর সবকিছু
আমার দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করেছি,
আমার নিষ্ঠা-আন্তরিকতা ছিল, সবই ঠিক
আছে। কিন্তু ওপরওয়ালার থেকে না আসলে
এটা আমার পক্ষে সম্ভব
হতো না। এটা আমি
মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
শুভ্র:
আল্লাহর পর মাকে সবচেয়ে
ভয় পান বললেন। এটা
একটু ব্যাখ্যা করবেন?
মাশরাফি:
এর মূল কারণও ধর্মবিশ্বাস।
ছোটবেলা থেকেই একটা কথা বিশ্বাস
করে এসেছি, এখনো বিশ্বাস করি, মা যদি
কোনো কথা বলে, এর
ওপরে কোনো কথা বলা যাবে
না। আমার ধর্ম আমাকে
এটাই বলে। আমি এটা
মেনে চলি।
দশের
সঙ্গে
প্রশ্ন:
মায়ের প্রতি শ্রদ্ধার যে কথাটা বললেন,
শুধু কি ধর্মের কারণেই
নাকি আপনার মায়ের ব্যক্তিত্ব, কার্যকলাপেরও ভূমিকা আছে এতে?
মাশরাফি:
তা তো আছেই। ধর্মের
কথা যদি বলেন, আপনি
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যে ধর্মেই যান;
কোনো ধর্মেই অসৎ কাজ করতে
বলা হয়নি। আমার মা-বাবার
কতগুলো জিনিস তো আমাকে প্রভাবিত
করেছেই। আমার মা-বাবা
যদি বলতেন, তুমি নামাজ পোড়ো
না, আমার মা-বাবা
যদি বলতেন, তুমি টাকাটা ওইভাবে
উপার্জন কোরো; আমার মা-বাবা
যদি বলতেন, তোমার মানুষকে দেওয়ার এত দরকার কী,
তুমি তোমার মতো থাকো, তাহলে
আমি একটু থমকে যেতাম।
আমি বড় হয়েছি মামার
কাছে—নাহিদ মামা। আমি আর মামা
একবার খেতে বসেছি, তো,
আমাদের বাসার সামনের মোড়ের এক চায়ের দোকানদার
ভণ্ডুলদা। ভণ্ডুলদার ডায়রিয়া হয়ে এমন অবস্থা,
বিছানা থেকে উঠতে পারছেন
না তিনি। আমরা কেউই সে
খবর জানতাম না। তো, কে
যেন একজন দৌড়ে এসে
খবর দিল। গিয়ে দেখি
ভণ্ডুলদার গায়ে ময়লা-টয়লা
লেগে আছে। ওই অবস্থায়
তাঁকে ভ্যানে উঠিয়ে আমি পাশে পাশে
দৌড়াচ্ছি। পরিবারই আমাকে এটা শিখিয়েছে যে
মানুষ বিপদে পড়লে তুমি আর কিচ্ছু
পারো না পারো, পাশে
থেকো। মা-বাবার ব্যাপারে
আপনি যে প্রশ্ন করলেন,
তার উত্তর হচ্ছে, আসলে তাঁদের দেখে
দেখে শ্রদ্ধা বাড়ছে। মা-বাবার প্রতি
ভালোবাসা সবারই থাকে। কিন্তু আমার আম্মার কিছু
কাজ যখন দেখি, শ্রদ্ধাটা
অন্য জায়গায় চলে যায়। আব্বার
কথাও বলতে পারি। আমার
আব্বা যা করছেন, এটা
বলার বিষয় নয়, আমি
বলতেও চাই না।
শুভ্র:
আমি যে শুনতে চাই...
মাশরাফি:
(হাসি) না, এটা বলব
না।
শুভ্র:
কেন?
মাশরাফি:
না, এটা আমার মুখে
ভালো শোনাবে না।
শুভ্র:
আমি তো কিছু কিছু
জানিই, বলে ফেলুন না...
মাশরাফি:
আমি বললে একটু খারাপ
দেখায়। শুধু এটুকু বলি,
আপনি এখন আমাদের বাড়িতে
গেলে দেখবেন, আমার আম্মার কাছে
৫-৭ জন ছোট
ছেলেমেয়ে আছে। কারও বাবা-মা নেই। কারও-বা মা মারা
গেছে, বাবা আরেকটা বিয়ে
করছে। আম্মা তাদের নিয়ে এসেছেন। তাদের
জন্য আম্মা গৃহশিক্ষক রেখেছেন। আমরা যা খাই,
তারাও তা-ই খায়।
আমার ছেলেমেয়ের কাপড়চোপড় যেখান থেকে কিনি, সেখান
থেকে তাদেরটাও কিনতে হয়। নতুন বাড়ি
করেছি, সেখানে তাদের জন্য আলাদা ঘরও
আছে। এটা আজকের ঘটনা
নয়, ছোটবেলা থেকেই এসব দেখে দেখে
বড় হয়েছি আমি। আমার আম্মাও
এসব দেখেই বড় হয়েছেন। কারণ,
আমার নানিও ছিলেন এ রকম। তাঁর
অনেক ঘটনা আছে, সব
বলতে চাচ্ছি না। শুধু একটা
ঘটনা বলি, যদিও এটা
বলতেও একটু অস্বস্তি হচ্ছে।
একদিন চার-পাঁচ বছরের
ছোট্ট এক ছেলে ভিক্ষা
করতে এসেছে। আমার নানি বললেন,
তুই থাকবি আমার কাছে? তুই
ভিক্ষা করিস কেন? তুই
আমার কাছে থাক। পড়ালেখা
করবি। ছেলেটা বলে, আমি মাকে
গিয়ে বলি? পরের দিন
ছেলেটা তার মাকে নিয়ে
এল। ওর মা নানিকে
বললেন, আমি তো ওকে
খেতেও দিতে পারি না,
আপনি রেখে দেন। ওই
ছেলেটা আমার মা-মামাদের
সঙ্গেই বড় হয়েছে। আমার
আম্মা, আমার মামারা তিন
ভাই-বোন। আমার আম্মার নামে,
আমার মামার নামে যতটুকু সম্পত্তি
আছে, নানা ঠিক ততটুকু
সম্পত্তি তাঁর নামে লিখে
দিয়েছেন। তাঁকে ওকালতি পড়িয়েছেন, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক বানিয়েছেন। তাঁর একটা মুদির
দোকান আছে। আমাদের বাড়ির
সমস্ত সম্পত্তিও তিনিই দেখাশোনা করেন। কেউ হিসাবও নিতে
যায় না। আমরা ছোটবেলা
থেকে এসব দেখেই বড়
হয়েছি।
আম্মার
একটা ঘটনা বলি। নড়াইলে
দিব্য ভারতী নামে একটা পাগল
ছিল। ও কাউকে নামে
চিনত না। একদিন বাসায়
আছি, দেখি ওই দিব্য
ভারতী এসে আম্মাকে বলছে,
‘এই বলাকা, (আমার আম্মার ডাকনাম)
ভাত দে।’ ও কোনো
দিনই ভাত খায় না,
শুধু মাটি খেত। তাই
খুবই অবাক হয়েছিলাম আমি।
বিস্ময় ছিল এ কারণে
যে, দিব্য ভারতী তো কাউকেই চেনে
না। কিন্তু আম্মার কাছে এসে তাঁর
নাম ধরে যে বলল,
এই বলাকা ভাত দে। পরে
মনে হয়েছে, নিশ্চয়ই আম্মার সম্পর্কে দিব্য ভারতীর মনে কোনো ধারণা
হয়েছিল।
আমার
আম্মা কোনো কিছু পাননি এর
বিনিময়ে। বা আমার নানা-নানি মারা গেছেন,
এর বিনিময়ে কী পেয়েছেন? মানুষের
কাছ থেকে সম্মান ছাড়া।
শুধু আপনাদের বা নড়াইলের মানুষের
কাছ থেকে সম্মানটুকুই পেয়েছেন
তাঁরা। তাঁরা খুব ধনী হতে
পারেননি। তাঁদের জীবনযাপন বদলে যায়নি। কিন্তু
তাঁরা মনে শান্তি নিয়ে
পিসফুল একটা জীবন যাপন
করেছেন। কারও মুখেই কোনো
অভিযোগ শুনিনি। তো, এগুলো দেখেই
বড় হয়েছি তো, এই জিনিসগুলোই
মাথায় ঘোরে।
শুভ্র:
তাঁরা হয়তো কিছু পাওয়ার আশায়
করেনওনি...
মাশরাফি:
আমিও ওটা করি না।
সত্যি কথা বলতে কি,
আমিও ছোটবেলা থেকে এ রকম।
কোনো কিছু একা করতে
পারি না। টাকাপয়সাকে কোনো
দিন টাকাপয়সা মনে করিনি। দশ
টাকা পেয়েছি, যখন এক টাকায়
২-৩টা আইসক্রিম পাওয়া
যায়, আমি দশ টাকাই
ভেঙে ফেলেছি। ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দিন
ভাবিনি। আমার আম্মা-আব্বাকেও
কখনো ভাবতে দেখিনি। তাঁদের বেশি চাহিদা নেই।
অল্পের মধ্যে ভালো থাকা—এতেই তাঁরা
বিশ্বাসী। এসব দেখে বড়
হয়েছি তাই আমার জীবনেও
সুখ-শান্তি বলতে এটাই। আমার
স্ত্রীও এমনই। সবাই মিলে আনন্দে
থাকতেই ভালোবাসে। এই যে কদিন
আগে বান্দরবানে ঘুরতে গেলাম, এর আগে কাশ্মীরে;
পুরো পরিবারের ১১-১২ জন
মিলে গেছি। আমি আর আমার
বউ আলাদা যেতে পারতাম। কিন্তু
তারও এক কথা—সবার
সঙ্গে যাব। এই জিনিসটাই
আমার কাছে ভালো লাগে।
এটা আমি উপভোগ করি।
শুভ্র:
বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা কি বন্ধুত্বের?
মাশরাফি:
বন্ধুত্বও বলতে পারেন। আবার
অনেক গ্যাপও আছে। গ্যাপ কী
ধরনের, আমি এখনো আমার
আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা
বলি না। কখনো যদি
মনে হয়, আব্বা এই
কাজটা ঠিক করছেন না,
আমি আম্মাকে বলি। চিল্লাপাল্লা করলেও
তা আম্মার সামনে। আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা
বলি না। আমি বা
আমার ভাই মানে আমরা
যারা ছোট আছি, বাসায়
মুরব্বিদের তুলনায় যারা ছোট, আমরা
মুরব্বিদের ওপরে কিছু চাপিয়ে
দিই না। তাঁরা যেটা
আমাদের ওপর চাপিয়ে দেন,
আমরা সেটাই করি।
শুভ্র:
মানে যে মাশরাফি বিন
মুর্তজা বাইরে সুপারস্টার, বাড়িতে তা একদমই নয়...?
মাশরাফি:
প্রশ্নই ওঠে না। এমন
ভাবার চিন্তাই করতে পারি না।
আবার আব্বা-আম্মাও আমার সিদ্ধান্ত ছাড়া
কোনো কাজ করতে চান
না। তবে এটা আমার
জন্য বেশ অস্বস্তিকর। তাঁরা
যখন জিজ্ঞেস করেন, এটা কী করব?
আমি বলি, তোমরা যা
ভালো মনে করো, সেটাই।
আমি কোনো সিদ্ধান্ত দেব না। কখনোই
কোনো সিদ্ধান্ত দেব না।
অধিনায়কের
মন
শুভ্র:
নেতৃত্বগুণটা আপনি কোত্থেকে পেয়েছেন
বলে মনে হয়? এটা
কি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া?
মাশরাফি:
বিশ্বাস করেন, এটা নিয়ে আমি
কোনো দিন ভাবিইনি। আর
আমার মধ্যে এটা আছে কি
না, খোঁজার চেষ্টা করিনি, আর জানিও না
ওটা আদৌ আছে কি
না।
শুভ্র:
আমি জানি, আছে। সবাই জানে।
মাশরাফি:
কী বলব, আমি আসলে
এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি।
জীবন নিয়েই আমি খুব ভাবি
না। কাল আমার জীবনে
কী আছে আমি জানি
না, ভাবিও না। আমার ছেলেমেয়ের
ক্ষেত্রেও একই কথা। ভাবিই
না। অনেকে বলে না যে,
ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা জ্ঞানীর কাজ,
আমি তা ভাবতেই পারি
না। টি-টোয়েন্টি থেকে
অবসর নিয়েছি, ৩০ সেকেন্ড সময়
লাগেনি আমার ভাবতে। নেব
তো নেবই। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। আমার মধ্যে নেতৃত্বের
গুণ আছে কি নেই,
দুই বছর কেটে যাবে
এ নিয়ে ভাবতে গেলে।
আসলে আমি কী বা
কী রকম, তা নিয়ে
ভাবি না। তবে নিজেকে
আমি খুব ভালো বুঝি।
এটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
নিজেকে খুব ভালো চিনি
আমি। যেমন ধরেন, কোনো
একটা কাজ যদি আমি
করি, কাজটা ঠিক না বেঠিক,
তা আমি ভালো বুঝি।
আমি মাশরাফি এই কাজটার উপযুক্ত
কি না, এটা আমি
বুঝে ফেলি।
শুভ্র:
সুনির্দিষ্টভাবে ক্রিকেটের ক্ষেত্রে আসি, অধিনায়ক মাশরাফিকে
যদি ব্যাখ্যা করতে বলি...
মাশরাফি:
টোটালি গাটস্ ফিলিং। আমার মন যা
বলে, সেটাই করি। এর বাইরে
কিচ্ছু করি না। মানে
তাৎক্ষণিকভাবে আমার মাথায় যা
আসে, আমি তা-ই
করি। এমন না যে,
খুব ভেবেচিন্তে কাজটা করছি। কিছু বুনিয়াদি জিনিস
তো অবশ্যই থাকে। ক্রিকেট খেলতে খেলতে আপনি অনেক কিছু
শিখবেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সেসব তো
মাথায় থাকেই।
শুভ্র:
অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী
ছিল?
মাশরাফি:
ছেলেদের বিশ্বাস করানো যে, আমরা জিততে
পারি। এই দলে আমার
চেয়ে কেউ বেশি হারেনি।
কত বাজেভাবে হারা যায়, সবই
দেখেছি আমি। আবার জেতার
আনন্দও দেখেছি। তাই আমার মনে
হয়েছে, জেতার আনন্দ ওরা যখন বুঝবে,
তখন ওদের ভেতরে জয়ের
তীব্র ইচ্ছাও আসতে শুরু করবে।
ভেবেছি, জেতার আনন্দটা পেতে হবে, সেটা
যে দলের বিপক্ষেই হোক।
আমরা যেমন জিম্বাবুয়েকে দিয়ে
শুরু করছি (ডিসেম্বর ২০১৪)। একবার
জেতা শুরু করলে আপনি
আরও জিততে চাইবেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটা জিতলাম, দুটো
জিতলাম, তিনটে...সিরিজ জেতার পর মনে হলো,
পরের দুটোও জিতব, আমরা ৫-০-তেই জিতলাম। ছেলেরা
একটা কিছু অনুভব করতে
শুরু করল। এরপর যখন
বিশ্বকাপ খেলতে যাই, আমি বিশ্বাস
করেছি যে, আমরা বিশ্বকাপ
জিততে যাচ্ছি। কয়েকজনকে বলেছিও, এই দল বিশ্বকাপ
জিততে পারে। এই সামর্থ্য আছে
আমাদের। ঠিক সময়ে আমাদের
দিনটা ভালো হলে আমরাই বিশ্বকাপ
জিততে পারি। ক্রিকেটে এই হয়ে আসছে।
না হলে দক্ষিণ আফ্রিকা
যে দল নিয়ে প্রত্যেকবার
বিশ্বকাপে যায়, তাতে প্রতিবার
ওদেরই জেতার কথা। আমার মনে
হয়, এ জন্যই আমরা
কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে পেরেছি—ওই বিশ্বাস ছিল
বলে। বিশ্বকাপে ছেলেদের বলেছিলাম—অন্য দলের কেউ
যদি তোমাদের কিছু বলে, পাল্টা
জবাব দেবে। আমি যা চেয়েছি,
তা হলো চোখে চোখ
রেখে খেলো। ওরা পাঁচটা কথা
বললে অন্তত তিনটার জবাব দাও। এটা
অন্য বড় দলকে নাড়িয়ে
দিয়েছে। ওরা তো আমাদের
কাছ থেকে এমন ব্যবহার
পেতে অভ্যস্ত নয়। এটা একটা
টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আসলে আমরা
যেখানে পিছিয়ে ছিলাম, সেটা হলো মানসিকতা।
আমাদের মনে বিশ্বাস ছিল
না।
শুভ্র:
বছরের পর বছর, ম্যাচের
পর ম্যাচ হারার অভিজ্ঞতার পরও আপনার মধ্যে
ওই বিশ্বাস কীভাবে এল?
মাশরাফি:
আমি গড়পড়তা অধিনায়কত্ব করতে চাইনি। পেয়েছি,
যে কদিন পারি করব—এ রকম করতে
চাইনি। প্রথম দুবার অধিনায়ক হওয়ার পর ইনজুরিতে পড়েছি।
তৃতীয়বার তাই অধিনায়কত্ব করতেই
চাইনি। আমাকে যখন বলা হলো,
আমি প্রস্তুত ছিলাম না। একেবারেই না।
আব্বাকে বললাম, আব্বা, অধিনায়ক হওয়ার পর আমার তো
দুবার ইনজুরি হয়েছে, আবারও ওই রকম একটা
ভয় থেকেই যায়। দুবার অধিনায়ক
হয়ে দুবারই ম্যাচের মধ্যে মাঠে পড়ে বসে
গেছি। আর কত! নিরিবিলি
খেলে যাই। কিন্তু আব্বা
বললেন, তুমি অধিনায়কত্ব নাও।
সেটা এক ম্যাচ হলেও
নাও। আব্বা যখন বললেন, তাঁর
সিদ্ধান্তে আর ‘না’ করিনি।
আর অধিনায়কত্ব নেওয়ার পরে একটা প্রতিজ্ঞা
করেছি, গড়পড়তা অধিনায়কত্ব আর করব না।
বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব করেছি,
এক বছর করেছি, ছয়
মাস করেছি, করে চলে গেছি—ওই রকম কিছু
করব না।
শুভ্র:
মানে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব যেমন বলেছিলেন,
পৃথিবীতে এসেছিস, একটা দাগ রেখে
যা...
মাশরাফি:
হ্যাঁ। সে জন্য সবার
আগে আমি নিজেকে বদলে
ফেলতে চেষ্টা করছি।
শুভ্র:
সেটা কী রকম?
মাশরাফি:
ধরেন, প্র্যাকটিসে বলেন বা ম্যাচে,
নিজে যে জিনিসটা করতে
চেয়েছি, সবার সামনে একটা
উদাহরণ দাঁড় করানো। সব ব্যাখ্যা করে
বলা যাবে না। এটা
দেখার বিষয়। ওই জিনিসগুলো হয়তো
একটা খেলোয়াড় ঠিকই বুঝেছে। আমি
যখন অন্য কাউকে বলব
যে, তুই এটা কর,
তখন আগে আমার ঠিক
হতে হবে। আমার হাজার
সমস্যার মধ্যেও আমি চেষ্টা করছি।
আমার জন্য কাজটা সহজ
ছিল না। পায়ে সময়
সময় ব্যথা করে। তারপরও আমি
একটা স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখতে চেয়েছি।
কারণ, আমি পড়ে গেলে
ওরা পড়ে যাবে।
শুভ্র:
মানে অন্য খেলোয়াড়েরা যেন
দেখে আপনি সব সময়
শতভাগ দিচ্ছেন...
মাশরাফি:
হ্যাঁ। তখন আমি একটা
কিছু বললে সবাই শুনবে।
আমি মাঠে পারফর্ম না
করতে পারি, কিন্তু প্র্যাকটিসে যদি চেষ্টা করি,
ওরা তো তা দেখবে।
ওরাও যদি প্র্যাকটিসটা ওভাবে
করে, ওদের চিন্তাভাবনা ওই
পর্যায়ে থাকে, তখন হবে। তারপর
একে একে আমরা নিজেরা
আলাপ করছি, কথা বলছি আমরা
আসলে কেমন, আমরা জিততে পারি
কি না। একেকজন একেক
রকম ভাবে। কেউ বলে, ভালো
খেলতে চাই। কিসের ভালো
খেলতে চাই? এক রানে
হারাও যা, ১০০ রানে
হারাও তা। ভালো খেলে
লাভ কী? জিততে হবে।
জিততে পারব কি না,
এটা বলো। ভালো খেলতে চাই বলে কী
লাভ? আমি যদি ১
রানে হারি আর ৫০০
রানে হারি, পার্থক্য কী? মানুষ বলবে,
লজ্জা পেয়েছ। লজ্জা আবার কী, খেলাধুলায়
আবার কিসের লজ্জা! বিশ্ব রেকর্ড হচ্ছে না, আমাদের সঙ্গেই
হয়নি! আমার বিপক্ষে হয়েছে
না বিশ্ব রেকর্ড? তো, আমি কি
লজ্জায় ঘুরে বেড়াচ্ছি নাকি!
আমার কথা হচ্ছে, আমি
খেলতে নামছি, দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে নামছি—আমার
দ্বিতীয় কোনো চিন্তাই থাকবে না, আমরা জিততেই
নামব। ভালো খেলে হারলেও আমি
আপসেট থাকব, খারাপ খেলে হারলেও আপসেট
থাকব। খারাপ খেলে জিতলেও হ্যাপি
হব, ভালো খেলে জিতলেও হ্যাপি
হব। এটাই হবে নিয়ম।
এর বাইরে কোনো নিয়ম নেই।
মেয়েকে
স্নেহের চুমু, পাশে স্ত্রী
শুভ্র:
অধিনায়ক হিসেবে বা নেতা—এমন
কেউ কি আছে, যাঁর
কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি
শিখেছেন...
মাশরাফি:
আমি আসলে প্রত্যেক মানুষের
সঙ্গে কমবেশি মেশার চেষ্টা করি, তা সে
যে শ্রেণিরই হোন। তবে আমি উঁচু
শ্রেণিকে খানিকটা এড়িয়ে চলি। মানে সমাজে
যাঁরা নেতৃত্বে আছেন। ওঁদের প্রতি আমার সম্মান আছে,
তবে ওই সমাজে আমি
স্বচ্ছন্দ বোধ করি না।
এমন না যে, আমি
ভাবি ওঁরা আমার যোগ্য
নন বা এমন নয়
যে ওঁদের আমি ঘৃণা করি।
আসলে আমি নিজেই ওঁদের
যোগ্য কি না, এ
বিষয়ে আমার মনে একটা
দ্বিধা থাকে। ভাবি যে, আমিই
হয়তো বা এই জায়গার
যোগ্য নয়। এ জন্য
দেখবেন, অনেক সময় আমি
অনেক জায়গায় থাকি না। আমার
জগতেই থাকি আমি। আর
শেখার কথা যদি বলেন,
শেখার শেষ নেই। অনেকের
কাছেই অনেক কিছু শিখেছি।
তবে আলাদা করে বলতে পারব
না কার কাছ থেকে
কী শিখেছি।
শুভ্র:
একটা সময় ছিল, যখন
সবাই ধরেই নিত বাংলাদেশ
হারবে। অধিনায়কের ওপর চাপও ছিল
কম। এখন সব ম্যাচেই
মানুষ জয় আশা করে।
তাই চাপও এখন অনেক
বেশি, তাই না?
মাশরাফি:
না, আমি কোনো চাপ
নিই না। তৃতীয়বারের মতো
অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর শুরু থেকেই
আমি একে ম্যাচ বাই
ম্যাচ নিয়েছি। আমার একটা সুবিধা
হলো, খেলাকে কখনো জীবন ভাবিনি। প্রচণ্ড
ভালোবাসি, এটা ছাড়া টিকে
থাকাও কঠিন। সবই ঠিক আছে।
কিন্তু এটাও মেনে নিয়েছি
যে, একদিন আমাকে খেলা ছাড়তে হবে।
এটাই বাস্তবতা। এটা আমার মাথায়
সব সময় আছে। শচীনকে
সুযোগ দিলে তো এক
শ বছরই খেলত। ওঁর
থেকে তো আর আমি
বেশি না। তিনি যেভাবে
ক্রিকেট খেলেছেন, তাঁর থেকে বেশি
আমি খেলতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, হয়তো
তাঁর চেয়ে বেশি ভালোবাসতেও
পারি। কে জানে! আমি
শুধু ভাবি, আমি একটা দায়িত্ব
পেয়েছি, যত দিন থাকি,
কাজটা যেন সততার সঙ্গে
করতে পারি।
জিতব...জিতব...
শুভ্র:
জিততে পারে বলে বিশ্বাস
নেই, এমন একটা দলকে
এমন নতুন একটা কথা
বললেন, বললেন জয়ী হতে হবে,
খেলোয়াড়েরা এটি কীভাবে নিয়েছিল?
এভাবে ভাবতে তো অভ্যস্ত ছিল
না তারা...
মাশরাফি:
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সিনিয়ররা এটা
কীভাবে নিচ্ছে। ওরা খুব ভালোভাবে
নিয়েছে। এটা ছিল ভালো
ব্যাপার। আমি প্রথমেই তাদের
সঙ্গে আলাপ করেছি এবং
তারা আমাকে পূর্ণ সহায়তা করেছে। ‘হ্যাটস অফ টু দেম’। দ্বিতীয় কথা
হচ্ছে, এমন তো নয়
যে এটা আমি আমার
জন্য চাচ্ছি। এটা আমি সাকিবের
(সাকিব আল হাসান) জন্য
চাচ্ছি, তামিমের (তামিম ইকবাল) জন্য চাচ্ছি। আমাদের
দলের লক্ষ্য যেটা, তার দিকে তাকাচ্ছি।
তাই এখানে কে কী ভাবল,
তা নিয়ে আমার মাথা
ঘামানোরই দরকার নেই। তুমি যদি
এটা মন থেকে নিতে
না চাও, তুমি চলে
যেতে পারো। দিন শেষে আমাদের
লক্ষ্য হলো, আমরা একটা ম্যাচ
জিতে বের হব। এটা
কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। আমার লাভের
জন্য কিছু করছি না।
যাকে বলছি, এতে তারও তো
ভালো। সবার ভালো, দেশের
মানুষেরও ভালো। এখানে ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই।
শুভ্র:
তারপরও এই বিশ্বাস সবার
মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া তো সহজ হওয়ার
কথা নয়...
মাশরাফি:
ভালো জিনিস হচ্ছে, আমাদের কিছু উদীয়মান তরুণ
ক্রিকেটার আছে। আর আমরা
সবাই জানি, ছোটবেলায় আপনি যে শিক্ষা
দেবেন, সেটা কেউ সহজে
ভোলে না। তো, ওরা
জাতীয় দলে এসে যখন
ওই কথা শুনবে, ওদের
মাথায় শুধু ওই কথাই
ঘুরপাক খেতে থাকবে যে,
জিতব-জিতব-জিতব...।
ওরা যদি দলে এসে
শোনে যে, ভালো খেলব-ভালো খেলব...ওটাই মাথায় ঢুকে
থাকবে যে, আমরা ভালো
খেলব। আমি ৩০ রান
করেছি, ভালোই তো খেলেছি। এসবে
কী হয়, আমি ভালো
করে জানি। সৌম্য (সৌম সরকার) দলে
এসেছে, হয়তো বাজে আউট হয়েছে।
এটা কোনো শট হলো? এটা
বাইরে বলার দরকার নেই।
ওর মুখের ওপর বলো। আমার
ব্যাটিং নিয়েই আমাকে সবাই ধুয়ে দিয়েছে
না! ছেলেপেলেরা এখনো ধুয়ে দেয় না!
এমনও বলছে, ভাই, এখানে আপনি
এইটুকু রান করতে পারেন
না! আমি এটাকে ভালোভাবে
নিয়েছি। আমি এটাই চেয়েছি
যে, তুইও আমারে বল।
আরে, আমি তো ভুল
করেছি, আমাকে কেন বলবে না!
আমি অধিনায়ক বলে? এটা হতে
পারে না। জুনিয়রদের আমি
আগে কথা বলতে দিয়েছি।
বলেছি, মুখ ব্যাজার করে
আছিস কেন, কথা বল।
ভুলভাল যাই বলিস, বল।
বলতে হবে তোর কথা।
এই সংস্কৃতিটা খুব ভালো ফল
দিয়েছিল ওই সময়। যে-ই ভুল করছে,
তাৎক্ষণিকভাবে না জানলেও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এক-দুই দিনের
মধ্যে ওটা জানতে পারছে।
সিনিয়র কেউ হলে হয়তো
এভাবে বলছে, ভাই, জুনিয়র হিসেবে
বলছি, ওই সময় আপনি
এটা করলেই পারতেন।
শুভ্র:
তার মানে আপনি চেয়েছেন
দলে এমন একটা পরিবেশ
তৈরি করতে, যেখানে সবাই যা মনে
হয় তা নির্দ্বিধায় বলতে
পারে, তাই তো?
মাশরাফি:
হ্যাঁ, সবাই যেন নিজেকে
এক্সপ্রেস করতে, মানে তুলে ধরতে
পারে। আর দলে এসেই
যেন ওই প্যাচপ্যাচানি না
শোনে যে, ভালো খেলব,
আমার রান আমি করব।
সবার যেন মাথায় থাকে—দলই সব। আমি
বলতে আমার দল।
নড়াইলে
নানা আতাউর রহমানের নামে গড়ে তোলা
মাশরাফির ক্রিকেট একাডেমি
পেশা
নয়, প্যাশন
শুভ্র:
দুই হাঁটুতে সাতবার অস্ত্রোপচারের পরও আপনার ক্রিকেট
খেলে যাওয়াটাকে শারীরবিজ্ঞানের এক বিস্ময় বলে
মনে হয় আমার কাছে।
এই যে বারবার এত
কষ্ট করে ফিরে এসেছেন,
কখনো কি মনে হয়নি,
ধুর, সব ছেড়েছুড়ে দিই...
মাশরাফি:
না। এমন যে কখনোই
মনে হয়নি, তা নয়। তবে
যখন চিন্তা করি, এটা তো
আমার পেশা নয়, এটা
আমার প্যাশন, তখন নতুনভাবে উজ্জীবিত
হই; আর প্যাশন ছেড়ে
থাকা খুব কঠিন। পেশা
ছেড়ে থাকা যায়, প্যাশন
ছেড়ে থাকা যায় না।
আপনি টাকা না হলে
চলতে পারবেন, কিন্তু মন ছাড়া চলতে
পারবেন না। আমার কাছে
জিনিসটা ওই রকম। না
হলে আমি যদি এখন
খেলা ছাড়ি, জানি, আরও বেশি আয়
করব আমি। কিন্তু ওটা
তো আমার পেশা হয়ে
গেল, প্যাশন নয়। আমার কাছে
টাকা অত গুরুত্বপূর্ণ নয়।
গুরুত্বপূর্ণ হলো, কোনটা আমার ভালো লাগে।
মোড়
ফেরানো ঘটনা
শুভ্র:
প্রায় সবার জীবনেই তো
এমন কিছু ঘটে, যা
জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। আপনার
জীবনের এমন কোনো ঘটনার
কথা কি বলতে পারেন?
মাশরাফি:
দুই-তিনটে আছে। এর মধ্যে
প্রথমটা ঘটেছে, যখন আমি পঞ্চম
শ্রেণিতে পড়ি, তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে
গিয়েছিলাম। মনে আছে, আমার
মাথার নিচে একটা বড়
পাথর ছিল। মানে মাথাটা
আরেকটু গেলেই ঘিলু-টিলু বের
হয়ে যেত আমার। এই
ঘটনা জীবনে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
মনে হয়েছে, আমি তো মরেই
যেতাম!
শুভ্র:
তখন আপনার বয়স কত?
মাশরাফি:
১০ বছর।
শুভ্র:
ওই ঘটনা কি আপনাকে
অনেক দিন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে?
মাশরাফি:
এখনো চিন্তা করি। চিন্তা করি
যে, আমি কীভাবে বেঁচে
আছি। দ্বিতীয় যে ঘটনার কথা
বলব, তা হলো ২০১১
বিশ্বকাপ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
ওই সময় আমি খেলা
ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছিলাম। মনে হয়েছিল, আর
কিসের জন্য খেলব! একটা
স্বপ্ন ছিল, দেশের মাটিতে
বিশ্বকাপ খেলব। সেটাই যখন হলো না,
তাহলে আর কী জন্য
খেলা? ওই বিশ্বকাপের সময়ই
আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আইসিইউতে (হাসপাতালের নিবিড পরিচর্যা কেন্দ্র) যায়, ১১ দিন
ছিল সেখানে। ২৪ ব্যাগ মতো
রক্ত লেগেছিল। একজন মানুষকে আমি
ভুলতে পারিনি, তাঁকে খুঁজি এখনো। আমি মোহম্মদপুরে অবস্থিত
রেড ক্রিসেন্টে গেলাম, প্লাজমা দরকার ছিল। আমার স্ত্রীর
অপারেশন হবে ১২টার সময়।
তখন বাজে ১০টা। প্লাজমা
প্রস্তুত করতে সময় লাগে
৬ থেকে ৮ ঘণ্টা।
তো, মোহাম্মদপুরে রেড ক্রিসেন্টের যে
ব্লাডব্যাংক, ওখানে যাওয়ার পরে একটা লোক,
ওনারও বাসার কেউ অসুস্থ। প্লাজমা
ছিল একটাই। আমাকে দেখে চেনার তিনি
পরে বললেন, ‘আপনার কি ইমিডিয়েটলি লাগবে?’
আমি বললাম, ‘দুই ঘণ্টা পরে
আমার স্ত্রীর অপারেশন।’ তিনি বললেন, ‘আমার
তো ১০-১২ ঘণ্টা
পরে লাগবে। আপনি এটা নিয়ে
যান। আমি আরেকটা রেডি
করতে বলি।’ এত ব্যস্ততার মধ্যে
আমি তাঁর নম্বর নিতে
পারিনি। ওই সময়ে তাঁকে
ধন্যবাদ জানিয়েছি। কিন্তু আমি তাঁকে জানাতে
পারিনি যে, তাঁর ওই
কাজটা কতটা মন ছুঁয়ে
গেছে আমার। মানুষটার চেহারাটাও মনে নেই। তখন
আমার এমন অবস্থা, কোন
পথ দিয়ে আমি ওখানে
গেছি, তাই-ই তো
খেয়াল নেই। ওই সময়ে
আমার মনে হয়েছে, আমরা
যে বলি ভালো মানুষের
সংখ্যা কম, এটা ভুল
কথা। মানুষ ভালো কাজ করছে না,
এটাও ভুল কথা। তা
না হলে এই বিশ্ব
বা একটা দেশ এভাবে
চলতে পারত না। অনেক
মানুষ ভালো ভালো কাজ করছে। আমরা
আসলে মানুষের সঙ্গে সেভাবে মিশি না বলে
বুঝি না। ওই মানুষটারও
তো কেউ অসুস্থ ছিল।
আমাকে প্লাজমা দেওয়ার ঝুঁকি তিনি না-ও
নিতে পারতেন। কোনো কিছু না ভেবেই
তিনি দিয়ে দিয়েছেন। তারপর
অপারেশন হলো। অপারেশন পর্যন্ত কোনো ঝুঁকি ছিল না। এরপর
তো চিকিৎসকেরা বলেই দিলেন, আমার
স্ত্রীর বাঁচার চান্স নেই বললেই চলে।
এরপর বউ আমাকে বলছে,
আমার কোনো ভুলভাল হয়ে থাকলে মাফ
করে দিয়ো। ওই সময়টা আমার
জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। তার
আগ পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অত
গভীরভাবে ভাবতে পারিনি আমি। তখন মনে
হলো, এই মানুষটা মরে
যাবে, চলে যাবে! ওপরওয়ালা
ঠিকই বাঁচিয়ে দিয়েছে। ওটা আমার জীবনে
আরেকটা বড় টার্নিং পয়েন্ট।
হাসপাতাল
থেকে স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় আসার
পরে প্রথমে ভাবছিলাম, অপারেশন আর করাব কি
করাব না। অপারেশন করালাম,
তবে এ সময় মাসখানেক
আমি কোনো রিহ্যাব-টিহ্যাবে (পুনর্বাসন প্রক্রিয়া) যাইনি। বাসায় বসে থাকতাম। ভাবতাম,
আর খেলে কী হবে!
তারপর একপর্যায়ে মনে হলো, জীবনে
তো সবই দেখে ফেলেছি।
হয়তো বিশ্বকাপ খেলতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বকাপে যদি খেলতাম, তাহলে
আমি আমার স্ত্রীকে হারিয়ে
ফেলতাম। কারণ, যেদিন আমার বউয়ের জীবন
নিয়ে টানাটানি, সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ম্যাচ ছিল। তার আগের
দিন সারা রাত হাসপাতালে
থেকে স্যালাইন দিয়েও ওর জন্ডিসটা ৭
থেকে ১২-তে চলে
গেছে। ওটা যদি আরও
বেড়ে যেত, তাহলে অপারেশন
করারই সুযোগ থাকত না। আর
ওর জন্ডিস ধরা পড়ার ঘটনাটাও
মনে রাখার মতো। সন্তানসম্ভবা অবস্থায় আমার স্ত্রীর খুব
বমি আসত। সূর্যের আলো
সহ্য করতে পারত না।
দিনের বেলায়ও সমস্ত ঘর অন্ধকার করে
রাখত, থাকত অন্ধকার ঘরে।
আম্মা তখন আমার ঢাকার
বাসায় ছিলেন। একদিন তিনি জোর করে
ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখেন, পুরো হলুদ হয়ে গেছে
আমার বউ। অন্ধকারের মধ্যে
তো কেউ বুঝত না।
ওদিকে বিশ্বকাপ দলে না থাকায়
আমার মনমেজাজ তখন ভীষণ খারাপ।
ফলে আমাকে কেউ কিছু বলত
না—না স্ত্রী, না
আম্মা। ওরা ওদের মতো
থাকত। একসময় আম্মা যখন দেখলেন এই
অবস্থা, আমাকে বললেন, তুই তাড়াতাড়ি ওকে
হাসপাতালে নিয়ে যা।
তো,
ওই সময় বিশ্বকাপ খেললে
আমি দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ম্যাচ নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। এদিকে ১০-১৫ দিন
ধরে আমার স্ত্রীর যে
শরীর খারাপ, সেটা সে কাউকে
বলেনি। হয়তো অনুভবও করতে পারেনি সেভাবে।
তাই এই দিনও হয়তো
ভাবত আর দশটা দিনের
মতো। অথচ আর একটু
দেরি হলেই ওকে হারিয়ে
ফেলতাম আমি। ফলে ভাবলাম,
আল্লাহ আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। যা হয়েছে, ভালোর
জন্যই হয়েছে। পরের দিন থেকেই
আমি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করে দিই।
ভাবি যে, আমি খেলব
এবং খেলার মতোই খেলব।
মাঠের
আনন্দ
শুভ্র:
খেলার প্রতি আপনার প্রচণ্ড ভালোবাসা অনুমান করতে পারি। না
হলে এত কষ্ট করে
এতবার ফিরে আসতে পারতেন
না আপনি। কখনো কি এটা ভেবে
ভয় লাগে যে, খেলা
ছাড়ার পর কী করব?
মাশরাফি:
না, একদমই ভয় লাগে না।
একদমই না। একটা জিনিস
শুধু চাই, যত দিন
খেলি, যেন মনের আনন্দে
খেলতে পারি। যেটা এখনো খেলছি,
মনের আনন্দ না থাকলে এটা
যেন আমি জোর করে
না খেলি। এ রকম যেন
না হয়, আমি আল্লাহর
কাছে এটাই চাই।
শুভ্র:
আপনার কাছে কি ক্রিকেট
খেলাই সবচেয়ে আনন্দের?
মাশরাফি:
বলতে পারেন। আমার বাচ্চাকাচ্চার সঙ্গে
সময় কাটানোটা আলাদা ব্যাপার। ওর সঙ্গে আমি
ক্রিকেটের তুলনা করব না। ওটা
পুরো ভিন্ন ব্যাপার। এমনি যদি বলেন,
আমার সবচেয়ে আনন্দ কী? আমি সব
সময় মাঠে আনন্দ পাই।
এই যে ধরেন ঢাকা
লিগ, আমি খেলে এত
মজা পাই! কী জন্য?
কারণ, সবার সঙ্গে দেখা
হয়। সবার সঙ্গে মিলেমিশে
গল্প, কথা। এটা তো
আমি খেলা ছাড়লে পাব
না। অনেকে আছে, খেলা ছেড়ে
দিয়ে ক্রিকেট বোর্ডে বা অন্য কোথায়
যেতে চায়। আমি চাই
না। আমি আরও খেলতে
চাই। ঢাকা লিগ খেলব।
সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হবে।
শুধু এই কারণে। না
টাকা, না কোনো কিছু।
এসব কিছু না।
শুভ্র:
মানুষ তো আর টাকা
হবে বা নাম হবে—এসব ভেবে খেলা
শুরু করে না। কিন্তু
একটা সময় চাপটাপ সব
মিলিয়ে যে কারণে খেলতে
শুরু করেছিল, সেটাই ভুলে যায়। আপনি
খেলার প্রতি এই ভালোবাসাটা সারা
জীবন ধরে রাখলেন কীভাবে?
মাশরাফি:
এটা আমার সব সময়ই
ছিল। আমার জীবনে অনেক
কঠিন সময় গেছে। যেমন
ধরেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই টেস্ট ম্যাচে
কোনো উইকেট পাইনি। ওই যে শাহাদাত
(শাহাদাত হোসেন) যেটাতে খুব ভালো বোলিং
করছিল (২০০৮)। তারপর
আমাকে প্রথম ওয়ানডেতে বাদ দেওয়া হলো।
আমি ওটা মেনে নিয়েছি।
কিন্তু অন্যভাবে যদি আপনি ভাবেন,
আমার রেকর্ড অনুযায়ী ওয়ানডে দল থেকে আমি
বাদ পড়ি না। তারপরও
যে আমাকে বাদ দিয়েছে, মেনে
নিয়েছি। কিন্তু আমার কষ্ট লেগেছে।
ওটা তো লাগবেই। স্বাভাবিক।
যে–কারোরই বাদ পড়লে খারাপ
লাগে। আবার বাস্তবতা মেনে
নেওয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা
মানুষকে অনেক সাহায্য করে।
যখন আপনি বাস্তবতা মেনে
নেবেন, তখন যুদ্ধ করতে
পারবেন। আর যদি মেনে
নিতে না পারেন, আপনি
ওই আঘাতেই হারিয়ে যাবেন। আমি মেনে নিয়েছি
সবকিছুই। বলতে পারেন ওটাও
আমার জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট।
নিজেকে বলেছি—ঠিক আছে, এটাও
জীবন।
শুভ্র:
ওয়ানডে থেকে বাদ পড়ার
পর আপনার হোটেল ছেড়ে যাওয়া নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল। সবার ধারণা ছিল,
আপনি রাগ করে চলে
গেছেন। কারণ, ওই সময়ে টিমের
মধ্যে পরিবেশটা আপনার জন্য খুব একটা
প্রীতিকর ছিল না।
মাশরাফি:
না, এটা হয়তো–বা
ছিল না।
শুভ্র:
পরে যখন অধিনায়ক হলেন,
তখন তো মনে হতেই
পারত, এবার আমার সুযোগ
এসেছে। আমার সঙ্গে যারা
খারাপ কিছু করেছে, তাদের
সেটা ফিরিয়ে দেব। কিন্তু আমি
জানি, আপনি তেমন কিছু
করেননি। নিজেকে কীভাবে সামলালেন?
মাশরাফি:
ও রকম কিছু আমার
মাথায়ই আসেনি। এটা আমি প্রায়ই
বলি, কারও খারাপ কাজের
জবাবে আমিও খারাপ কিছু
করলে তার আর আমার
ভেতরে তো কোনো পার্থক্য
থাকল না। কখনো কোনো
কিছুতে প্রতিক্রিয়া দেখাই না আমি। আমার
সঙ্গে যে কিছু হয়নি,
তা নয়। আমি বলতে
পারি, কী কী হয়েছে।
কিন্তু আমি বলতে চাই
না। কারণ, এটা নিয়ে লেখালেখি
হোক, সেটা চাই না।
অনেক কিছুই হয়েছে। তবে কখনোই প্রতিক্রিয়া
দেখাইনি। এই যে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিলাম,
অনেক কিছু তো আমিও
বলতে পারি। সবাই সবার মতো
বলছে। অথচ আমি একটা
কথাও বলছি না। আমি
ভাই আমার মনের খুশিতেই
গেছি। আমার প্রতিক্রিয়া আলাদা।
আমার সঙ্গে কেউ কিছু অন্যায়
করলে ওটা যে আমার
মনে থেকে যায়, তা-ও না।
শুভ্র:
এটা কীভাবে পারেন?
মাশরাফি:
আমি বিশ্বাস করি, আপনার ভালো
কাজের প্রতিদান আপনি পাবেনই। দ্বিতীয়
কথা হচ্ছে, আপনি যদি ঠিক
কাজ করে যান, নিজের
অন্তরকে বুঝ দেওয়া যায়
যে, আমি অন্যায় কিছু
করিনি। আপনি যখন জানবেন,
অন্যায় কিছু করেননি, তখন
আরেকজন যদি আপনাকে হাজারো
অপবাদ দিয়ে যায়, তাতে
কিছুই আসে–যায় না।
আমার কাছেও ওটা কোনো বিষয়
নয়। আপনি হয়তো আমাকে
জিজ্ঞেস করবেন, হাজারো মানুষ হয়তো বলবে, মাশরাফি ওটা করেছে। কিন্তু
ওপরওয়ালা তো দেখছেন। আমিও
নিজের কাছে পরিষ্কার। আমি
যদি নিজের কাছে অপরিষ্কার হই
আর হাজার মানুষের কাছে পরিষ্কার হই,
লাভ কী? কোনো লাভ
নেই। আমার ব্যক্তিগত এমনও
বন্ধু আছে, এখন বন্ধুই
বলব, তারা হয়তো এখন
আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু;
আমার সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছে।
তো, আমি তাদের সব
সময় বেশি কাছে রাখতাম।
তুই কত করবি? কর,
কোনো সমস্যা নেই। আমি যাতে
শান্তি পাই, তা–ই
করি। আমি ওদের উপকার
করে শান্তি পাই। ওদের ক্ষতি
না করে শান্তি পাই
বা ওদের বিপদে কাছে
থেকে শান্তি পাই। একজন কিছু
করেছে আর আমাকে তার
জবাব দিতে হবে, এই
জিনিসটা আমার একদমই নেই।
আমার
সন্তান যেন...
শুভ্র:
একবার কোন একটা ম্যাচ
শেষে সংবাদ সম্মেলনে অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলেন।
খেলাধুলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে একটা প্রশ্ন
হয়েছিল, জবাবে আপনি বলেছিলেন, খেলা
কোনো চ্যালেঞ্জই না। আসল চ্যালেঞ্জ
ছেলেমেয়েকে মানুষ করা। তাৎক্ষণিকভাবে কীভাবে
অমন একটা কথা মনে
হলো?
মাশরাফি:
আমি মনে করি, সব
বাবা-মায়ের জন্যই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ওটাই।
আমি যা হয়েছি, তা
আমার আব্বা-আম্মার প্রতিফলন। আমাকে যদি পাঁচটা মানুষ
ভালো জানে, আমি চাইব আমার
ছেলেমেয়েকেও মানুষ ওভাবে জানুক। একজন বাবার কাছে
আপনি জিজ্ঞেস করে দেখবেন, আপনি
নিজেও বাবা। একজন রিকশাওয়ালার কথাই
ধরুন না, একজন রিকশাওয়ালার
জায়গায় সে কিন্তু মহান।
সে রিকশা চালিয়ে ২০ বছর ধরে
হয়তো ছেলেমেয়েকে মানুষ করছে। কী কারণে? ছেলেমেয়ের
কাছে তার একটাই চাওয়া—তুই ভালো কিছু
কর। তুই ভালো কিছু
হ। আমিও আমার ছেলেমেয়েকে
এই শিক্ষাতেই বড় করতে চাই।
আমার মতো আমার স্ত্রীও
চায় না, ওরা ভোগবিলাসী
জীবন যাপন করে বড়
হোক। আমাদের চিন্তাভাবনা একটাই, ওরা যেন ভালো
মানুষ হয়। এটাই আসল,
টাকাপয়সার দিক থেকে ফকির
হয়ে থাকলেও কিছু আসে–যায়
না। এই একটু আগেও
বাসায় বউয়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ে নিয়েই আলাপ করে এসেছি।
ওদের সঙ্গে কীভাবে কথা বললে ভালো
হয়। আমার ছেলেটার বয়স
এখন আড়াই বছর। ওর সঙ্গে
এখন কীভাবে ঠিক কথা বলতে
হবে—এসব খুঁটিনাটি বিষয়
নিয়েই আলোচনা বেশি হয়। আমার
মেয়ে কি খারাপ কিছু
করছে? কাজের মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে দেখলে আমার
মাথা খারাপ হয়ে যায়—কেন
এমন করবে? ওর মাত্র ছয়
বছর বয়স, ও তো
কিছু বোঝে না। ওর বন্ধু,
ওর শিক্ষক; যা-ই বলেন,
আমার বাসায় ১০-১২ বছরের
একটা মেয়ে আছে—টুনি
নাম, ও-ই সব।
ওর দেখভাল, ওর খাওয়াদাওয়া...সব
সে-ই করে। ওরা
আবার বন্ধুও। আমার মেয়ে ওর
সঙ্গে যখন একটু খারাপ
ব্যবহার করে, ওটা আমাকে
ভাবিয়ে তোলে। ওকে যখন বকা
দিই, এটা তুমি কেন
করলে? ও বলে, ভুল
হয়ে গেছে। আমি বলি, তো
টুনি আপু চলে যাক
বাসায়! ও বলে, না,
আমি আর জীবনেও করব
না। মেয়ের সঙ্গে কথা বলে আসলে
আমি এটাই বোঝার চেষ্টা
করি যে, ওর মানসিকতা
ঠিক আছে কি না।
আমার স্ত্রীও এ রকম। ছেলেমেয়ে
কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে কি না,
এটা আমরা খুব খেয়াল
করি। এসব করতে গিয়ে
দেখছি, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ এগুলোই।
খেলা তো অনেক পরের
জিনিস, এক অর্থে অনেক
সহজও। আমাকে যখন ওই প্রশ্নটা
করা হয়েছে, আমার মনে হয়েছে,
খেলা আর কী চ্যালেঞ্জ,
আমি তো দেখি আমার
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে
দাঁড়িয়েছে ওটা। আমার মেয়ে
একটা ভুল করছে, এটাই
শিখে গেলে জীবনে একটা
বাজে জিনিস শিখে গেল।
নেতৃত্বের
মন্ত্র
শুভ্র:
অধিনায়কত্ব বা নেতৃত্বের একটা
বড় অংশ হচ্ছে সতীর্থ
খেলোয়াড়দের নিয়ে একসঙ্গে চলা
এবং তাদের পরিচালনা করা। যেহেতু মানুষ
নিয়ে কাজ। একেকটা মানুষ
একেক রকম, একেকজন একেকভাবে
উদ্দীপিত হয়। এখানে আপনার
মন্ত্রটা কী?
মাশরাফি:
প্রথমেই বলব, সবাই কিন্তু
একটু ভালো ব্যবহার চায়। আপনি একজন
সৈনিককে যদি রুটি আর
ছুটি দেন, সে আপনার
জন্য জীবন দিয়ে দেবে।
প্রত্যেক মানুষ ভালো ব্যবহার চায়, একটু আস্থা
চায়। অনেকেই জানে, আমি হয়তো কিছুই
করতে পারব না। কিন্তু
আমি ওর সঙ্গে যদি
খানিকটা মিশি, একটু থাকি, সময়
দিই, তাহলে অবশ্যই ওর ভালো লাগতে
পারে। তবে এটাও বুঝতে
হবে যে, আমার সঙ্গ
তার ভালো লাগছে কি না। আমার
ক্ষেত্রে যেটা হয়, আমার
ছেলেপেলে যারা আছে, আমার
দলে যারা আসে, প্রত্যেককে
আমি অত্যন্ত ভালোবাসি। আমার পরিবার ভাবি।
সব সময় কাউকে কিছু
বলার আগে চিন্তা করি
যে ওর মা আছে,
বাবা আছে, ভাই আছে।
আমার আচরণে ও যদি কষ্ট
পায়, যদি ওর কোনো
ক্ষতি হয়, অবশ্যই ওর
মা-বাবার সেটা খারাপ লাগবে।
ছেলে হয়তো বাবার সঙ্গে আলাপ করবে যে,
মাশরাফি আমাকে এই বলেছে। ওর
বাবা আমাকে কিছু বলবেন না—বলার সুযোগও নেই—কিন্তু তাঁর তো খারাপ
লাগবে। এটা আমি সবার
আগে ভাবি। অন্যদের কাছ থেকেও এটাই
আশা করি। কারণ, আমারও
পরিবার আছে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে
আমরা এক জায়গায় আছি।
সতীর্থ খেলোয়াড়দের নিয়ে একসঙ্গে চলা
এবং তাদের পরিচালনা কথা যদি বলেন,
আমি একে খুব সাদামাটাভাবে
দেখি—সবার সঙ্গে ভালোভাবে
সহজ-সরলভাবে চলা এবং আনন্দ-ফুর্তি করা।
আমাদের
দলের জন্য এটা আরও
বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা খুব দ্রুত
‘হোমসিকনেসে’ আক্রান্ত হই। এই যে
ইংল্যান্ড পাঁচ-ছয় মাস
ধরে ট্যুর করে, আমাদের জন্য
এটা কঠিন। ওদের গার্লফ্রেন্ড বা
ওদের বউ সঙ্গে থাকলেই
হয়। আমাদের তা হয় না।
আমাদের বাবা-মা লাগে,
বন্ধুবান্ধব লাগে। দেশের আলো-বাতাস লাগে।
আমি আমার ১৭ বছরের
অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলছি।
এ কারণে বলি, লম্বা ট্যুরে
সম্ভব হলে মাঝখানে চার-পাঁচ দিনের জন্য
হলেও আমাদের দেশে ফিরতে দেন।
পরিবারের সঙ্গে থাকতে দেন। লম্বা ট্যুরে
একটা ভয় থাকে আমার।
এই জন্য আমি ওদের
সঙ্গে মিশি, ঘুরি, কথা বলি। একসঙ্গে
আনন্দ-ফুর্তি করার চেষ্টা করি।
এই যেমন শ্রীলঙ্কায় আমরা
রান্না করে খেয়েছি। সবাই
মিলে এবং সবাইকেই কাজ
করতে হয়েছে। এমনকি সাকিবও পেঁয়াজ না হলে কিছু
একটা কেটেছে। ভালো দিক হলো, আমরা
সবাই সবার সঙ্গ পছন্দ
করি। এর ভেতরে খারাপ
লাগা-ভালো লাগা, গন্ডগোল যে হয় না,
তা নয়। একসঙ্গে চলতে
গেলে এটা হয়ই। আবার
সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে
যায়। এমন নয় যে,
আমাদের সিনিয়রদের ঢুকতে হয়, ওরা নিজেরাই
ঠিক করে ফেলে। এতে
ওরাও নেতৃত্ব বিষয়টা শিখছে। ওদের গন্ডগোল হচ্ছে,
ওরাই ঠিক করে নিচ্ছে।
আমাদের সুবিধা হলো, আমরা অন্য দেশের
মতো না। ব্যক্তিত্বের সংঘাত,
এ-ওর সম্পর্কে কথা
বলছে...। আমাদের মধ্যে
এসব দেখবেন না।
শুভ্র:
এর বড় একটা কৃতিত্ব
আপনারই পাওনা। দলে এমন পরিবেশ
তৈরি করেছেন বলেই এমন হয়েছে।
সব সময় তো এমন
ছিল না।
মাশরাফি:
ওই ছেলেগুলোকেও এ জন্য অবশ্যই
সাধুবাদ দিতে হবে। ওদের
এমন মানসিকতা না থাকলে এটা
সম্ভব হতো না।
শুভ্র:
দলের বাকি সবার চেয়ে
বয়সে আপনি বড়, ক্যারিয়ারের
দিক থেকেও অনেক সিনিয়র, এটা
কি আপনাকে সাহায্য করেছে?
মাশরাফি:
বয়সে কমবেশি আছে। তবে তামিম-সাকিবরা কিন্তু নিজেদের নিয়ে অনেক বেশি
আত্মবিশ্বাসী। অন্যায় কিছু হলে ওরা
মেনে নেবে না। এমন
নয় যে, বয়সে-ক্যারিয়ারে
বড় আর অধিনায়ক বলে
আপনি অন্যায় কিছু করেও পার
পেয়ে যাবেন। নিজে করবেন না,
অথচ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেবেন,
এ রকম কিছু হবে
না।
শুভ্র:
শেষ প্রশ্নটি সেই শুরুর প্রসঙ্গ
দিয়ে। আপনাকে নিয়ে এখন মানুষের
এই যে এত আবেগ,
এত ভালোবাসা, এতে কী মনে
হয়, মানুষের যা প্রাপ্য দেরিতে
হলেও সে সেটা পায়?
আপনাকে আমরা যারা ঘনিষ্ঠভাবে
দেখেছি, তারা তো জানতামই
আপনি কেমন। কিন্তু ২০১৪ সালে আপনি
অধিনায়কত্ব না পেলে আমজনতার
কাছে বিষয়টি অজানাই থেকে যেত।
মাশরাফি:
প্রথমত বলব, ২০১৪-এর
আগে আমি যা ছিলাম,
এখনো তা-ই আছি।
আমার চিন্তাভাবনায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনেকে অনেক কিছু বলতে
পারে। আমাকে নিয়ে কারও যে
বাজে ধারণা নেই, এমনও নয়।
আমি তো আর তা
বদলাতে পারব না। সব
সময় একটা জিনিসই চেয়েছি
আমি—যেন মনের আনন্দে
খেলি। ২০০১ সালে মনের
আনন্দে খেলতে শুরু করেছিলাম। ২০১৭-তেও মনের আনন্দেই
খেলছি। মনের আনন্দে কাজ
করার মজাই আলাদা। ওই
যে রাতের বেলা ব্যাগ-ট্যাগ
গুছিয়ে সকালবেলা উঠে মাঠে যাওয়া...সকালে বিছানা থেকে নামতে আমার
খুব কষ্ট হয়, পা
দুটো অসাড় হয়ে থাকে, তারপরও
ওটাই আমি উপভোগ করি
এখনো। এমনকি ঘরোয়া লিগে ক্রিকেটে খেলাও।
খেলাটা আমি মনের আনন্দেই
খেলছি। এর মধ্যে যে
এত কিছু ঘটে গেছে,
ওই যে বললাম, আমি
বিশ্বাস করি, ওপরওয়ালা আপনাকে
কখন কী দেবে, সেটা
আপনি জানেন না। তবে চলার
পথে সব সময় একটা
বিষয় আমার মাথায় থাকে,
আমাকে যদি কেউ ভালোবাসে,
তার কাছে যেন কখনো
খারাপ না হই। যদি
আমাকে কেউ খারাপ জানে,
সেটা বিভিন্ন কারণে জানতেই পারে। তার চিন্তাভাবনা হয়তো
আমি বদলাতে পারব না। কিন্তু
আমার দায়িত্ব হচ্ছে একজন মানুষ হিসেবে
ঠিক কাজ করার চেষ্টা
করা। সব সময় একজন
মানুষ যে ঠিক কাজ
করতে পারে তা না,
বা ঠিক কাজ মনে
করে সে যা করছে
সেটাই যে ঠিক, তা-ও সব সময়
সত্যি নয় হয়তো। তবে
মনের আনন্দে ভালো করে যাওয়ার চেষ্টা
করে যাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। পরে কী হলো
না হলো, সেটা পরের ব্যাপার।