সেদিন ছিল তাঁর বিয়ে। কিন্তু নির্ধারিত সময়েও বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা মিলল না তাঁর। ওই সময় কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, বিয়ের কনেকে অপহরণের পর ধর্ষণ করা হয়েছে; পরে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে রাস্তার ধারে।
বিয়ের দিনটি যে কারও জীবনের স্মরণীয় দিনগুলোর একটি। আর সেই দিনটিতে এই বীভৎস নির্যাতনের শিকার হন তরুণী টেরি গোবাঙ্গা। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির বাসিন্দা টেরির জীবনের দুটি বড় বিয়োগান্ত ঘটনার প্রথমটি হলো এটি।
সেই বীভৎস নির্যাতনের বর্ণনায় টেরি বলেন, ‘সেদিন ছিল আমার বিয়ে। বেশ বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমি প্যাস্টর (গির্জার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট) ছিলাম। তাই আমার গির্জার সদস্যদেরও বিয়ের অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল। আমি ও আমার হবু স্বামী বিয়ে নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত ছিলাম। নাইরোবির অল সেইন্টস ক্যাথেড্রালে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের জন্য একটি সুন্দর পোশাক ভাড়া নিয়েছিলাম আমি।’
কিন্তু বিয়ের আগের দিন রাতে হঠাৎ টেরির মনে পড়ে, হবু স্বামী হ্যারির কিছু পোশাক তাঁর কাছে আছে। এর মধ্যে টাইও ছিল। টেরি বলেন, ‘বিয়ের দিন ভোরবেলা উঠে হ্যারিকে পোশাকগুলো দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার এক বন্ধুও এতে সায় দিয়ে বলল, সে নিজেই নিয়ে যাবে পোশাকগুলো। সূর্য ওঠার পরপরই বেরিয়ে পড়ি আমরা। বন্ধুটিকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিই আমি।’
এরপর বাড়ি ফিরছিলেন টেরি। তিনি জানতেন না, কী ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন তিনি। টেরি বলেন, ‘ফেরার পথে রাস্তায় দেখি একটি লোক গাড়ির বনেটের ওপর বসে আছে। হঠাৎ পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরে লোকটি; জোর করে গাড়ির পেছনের সিটে তুলে নেয়। গাড়ির ভেতরে আরও দুজন ছিল। আমাকে তুলে নিয়েই গাড়ি ছেড়ে দিল তারা। মনে হয় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে গেল এ ঘটনা। আমার মুখের ভেতরে কাপড়ের টুকরো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি ক্রমাগত হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করার চেষ্টা করছিলাম। কাপড়টা কোনোক্রমে মুখ থেকে বের করেই চিৎকার করে বললাম, আজ আমার বিয়ের দিন। কিন্তু তারা কোনো কথা শুনল না। উল্টো আমাকে বলল, মেনে নাও নয়তো মারা যাবে। এরপর তারা একে একে আমাকে ধর্ষণ করে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে মারাই যাব। তবে বাঁচার চেষ্টাও করছিলাম। বাঁচার জন্য একজনকে খুব জোরে লাথি মারি। সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে এবং আমার পেটে ছুরি মারে। এরপর তারা দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয় আমাকে।’
নাইরোবির বাড়ি থেকে কয়েক মাইল দূরের রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন টেরি। অপহরণের প্রায় ছয় ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছিল তখন। একটি শিশু তাঁকে দেখতে পায়। শিশুটি নিজের দাদিকে ডেকে আনে। এরপর আরও অনেক মানুষ জড়ো হয় সেখানে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ তাঁকে মৃত মনে করে একটি কম্বলে জড়িয়ে মর্গে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। কিন্তু মর্গে নেওয়ার পথে হঠাৎ কাশতে থাকেন টেরি। তখনই গাড়ি ঘুরিয়ে কেনিয়ার সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালে টেরিকে নেওয়া হয়।
টেরির জবানিতে, ‘আমি তখন প্রায় অর্ধনগ্ন ও রক্তাক্ত। বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলাম। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কেন জানি ভেবেছিলেন, আমি কনে! তখনই বিভিন্ন চার্চে খোঁজ নেওয়া শুরু হয়। কাকতালীয়ভাবে প্রথমেই তাঁরা ফোন করেছিলেন অল সেইন্টস ক্যাথেড্রালে। এর কয়েক ঘণ্টা পরই আমরা বাবা-মা, হ্যারিসহ সবাই হাসপাতালে ছুটে আসে।’
ওই সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদকেরাও হাসপাতালে ভিড় করেছিলেন। ভিড়-বাট্টার কারণে টেরিকে পরে সরিয়ে নেওয়া হয় আরেক হাসপাতালে। সেই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা টেরিকে শোনান আরেক ভয়ংকর সংবাদ। ছুরির আঘাতে গর্ভাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আর মা হতে পারবেন না তিনি।
টেরি বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা মেনে নিতে পারছিলাম না। এইচআইভি বা এইডস রোগ থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছিল আমাকে। হ্যারি বারবার বলছিল যে সে আমাকেই বিয়ে করতে চায়।’ তিন মাস পর চিকিৎসকেরা বলেন, টেরির এইডস হওয়ার ঝুঁকি নেই।
তবে পুলিশ ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। টেরি বলেন, ‘আমি দিনের পর দিন সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করতে থানায় গিয়েছি। কিন্তু কাউকে চিনতে পারিনি। প্রতিবারই মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হতাম। এতে আমার পুনর্বাসনপ্রক্রিয়াও পিছিয়ে যায়। শেষে একদিন থানায় গিয়ে পুলিশকে বললাম, আমি আর পারছি না। আমি এই ঘটনাটি ভুলে যেতে চাই।’
ধর্ষণের শিকার হওয়ার সাত মাস পর, ২০০৫ সালের জুলাই মাসে সেই হ্যারির সঙ্গেই বিয়ে হয় টেরির। কিন্তু বিয়ের ২৯ দিনের মাথায় মারা যান হ্যারি। শুরু হয় টেরির জীবনের আরেকটি দুঃসহ অধ্যায়। টোরি বলেন, ‘আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। মাত্র এক মাস আগেই সাদা গাউন পরে যে গির্জায় আমার বিয়ে হয়, সেখানেই আমি হাজির হয়েছিলাম কালো রঙের পোশাক পরে। আশপাশের মানুষ আমাকে অভিশপ্ত বলে মনে করছিল। কেউ তাঁদের সন্তানকে আমার কাছে ঘেঁষতে দিত না। একপর্যায়ে আমিও নিজেকে অভিশপ্ত বলেই ভাবতে শুরু করেছিলাম।’ অথচ ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, ঘরের ফায়ার প্লেসে কয়লা পুড়ে বেশি কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হওয়ায় শ্বাসকষ্টে মারা যান হ্যারি। ওই সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন টেরিও। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হন তিনি।
টেরি ও টনি গোবাঙ্গা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
হ্যারির মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন টেরি। আর বিয়ে করবেন না বলেও মনস্থির করে ফেলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ তাঁর জীবনে আসেন টনি গোবাঙ্গা। টেরিকে তিনি জীবনের ভালো ঘটনাগুলো মনে করার পরামর্শ দেন। একসময় বিয়ের প্রস্তাব দেন টনি। কিন্তু এ নিয়ে টনিকে আরও ভেবে দেখার কথা বলেন টেরি। তিনি যে সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন না, সেটিও জানান টনিকে। ওদিকে টনির বাবা-মা টেরির অতীত জেনে বাদ সাধেন বিয়েতে। শেষে টনি রাজি করান সবাইকে। বিয়ে হয় টনি ও টেরির।
অন্ধকারের পরই আলো আসে। দ্বিতীয় বিয়ের এক বছর পর একদিন চিকিৎসক টেরিকে বলেন যে তিনি মা হতে চলেছেন। একটি কন্যাসন্তান হয় তাঁর, নাম রাখা হয় তেহিলে। এর চার বছর পর আরেকটি কন্যাসন্তান হয় টনি-টেরি দম্পতির। এখন দুই সন্তানকে নিয়ে এ দম্পতির সুখের সংসার।
অন্ধকারের পরই আলো আসে। দ্বিতীয় বিয়ের এক বছর পর একদিন চিকিৎসক টেরিকে বলেন যে তিনি মা হতে চলেছেন। একটি কন্যাসন্তান হয় তাঁর, নাম রাখা হয় তেহিলে। এর চার বছর পর আরেকটি কন্যাসন্তান হয় টনি-টেরি দম্পতির। এখন দুই সন্তানকে নিয়ে এ দম্পতির সুখের সংসার।
এই টেরি গোবাঙ্গা বর্তমানে ধর্ষণের শিকার নারীদের নিয়ে কাজ করেন। এ জন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। যেখানে ধর্ষণের শিকার নারীদের নতুন আশার আলো দেখানো হয়। তাদের বিশ্বাস করতে শেখানো হয়—ধর্ষণের জন্য তিনি দায়ী নন। তিনি ঘটনার শিকার। তাঁর কোনো দোষ নেই। টেরি তাঁদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন এবং নানা বিষয়ে সহায়তা করেন। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বইও লিখেছেন তিনি। সেই বইয়ে তাঁর মতো নির্যাতিত নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা তুলে ধরেছেন।
টেরির কথায়, ‘আমাকে যাঁরা আক্রমণ করেছিল, তাঁদের আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। এটি সহজ ছিল না। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এমন মানুষদের জন্য আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম, যাঁদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই! আমার বিশ্বাস আমাকে ক্ষমা করতে উৎসাহিত করেছে। মন্দ কিছুর বদলা মন্দ কাজ দিয়ে হয় না। এর বদলে ভালো কাজ করতে হয়।’
About Admin MC3
This is dummy text. It is not meant to be read. Accordingly, it is difficult to figure out when to end it. But then, this is dummy text. It is not meant to be read. Period.